Wednesday 1 July 2020

পিথাগোরাসের উপপাদ্য




পিথাগোরাসের উপপাদ্য 



পিথাগোরাসের উপপাদ্যটা মনে আছে? সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের দৈর্ঘের বর্গ বাকিদুটো বাহুর দৈর্ঘ্যের বর্গের যোগফলের সমান। ব্যালকনি থেকে শহরের মেঘলা রাতে যেটুকু ফুরিয়ে আসা টুপ্টাপ শোনা যায় সেটুকু শুনতে শুনতে আট নম্বর পেগের গ্লাসটা নামিয়ে অনুরাগ  বলল পিথাগোরাস আসলে সম্পর্কের থিওরেম দিয়ে গ্যাছেন। কেমন করে?  ধরে নি অতিভুজ বাদে বাকি দুটো বাহু আসলে দুটো মানুষ। আর অতিভুজ সম্পর্ক। একটা মানুষের ভালো খারাপ দুটোই থাকে তাই বর্গ। তর্ক এবং পেগের খাতিরে ধরে নি ভালো ও খারাপের পরিমাণ সমান। এখন মুশকিল হল আমরা খারাপটুকু বাদ দিয়ে শুধু ভালো টুকু নিয়ে ডিল করতে গিয়েই অতিভুজে হোঁচট খেয়ে যাই,কি বল?

তাহলে অতিভুজের বর্গটা কি? অতিভুজ কেন বর্গ হয়?

গুড,ভেরি গুড কোয়েশ্চেন- আসলে সম্পর্কের সৃষ্টিই হয় দুটো অব্জেক্টের ইন্টারঅ্যাকশনের ফলে। তাতে দুটো অব্জেক্টের মিলিত অনুভূতি থাকে,তো অ্যাপারেন্টলি একটা এনটিটি হওয়ার কথা তাই না? কিন্তু তা হয় না। কেন হয় না? কারন সম্পর্ক সিঙ্গেল এনটিটি না। দুটো (নন-ইনঅ্যানিমেট) অব্জেক্টের অনুভূতি ইন্ডিপেন্ডেন্টলি মুভ করে।ল অব সেগ্রিগেশন পড়েছিলি তো? মেন্ডেলের? 
সে তো কোন ছোটোবেলায়
হ্যাঁ,ওখানেও একটা বিবরণ...এই কি হল...বমি পাচ্ছে?

আবাহন কে বমি করিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসল অনুরাগ। মেঘা আর একটা সোফায় ঝিমুচ্ছে। অনুরাগ মনে মনে ভাবছে গাঁজাখুড়ি গল্পের লেভেলটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। বেশ লজ্জা লজ্জা লাগল তার। খুব বেশি কারোর সাথে সে এখন আর আড্ডা মারে না। এক আধদিন শুধু আবাহন আর মেঘা আসে,ব্যাস। পাশ ফিরে অনুরাগ দেখল আবাহন ঘুমিয়ে পড়েছে,মেঘা তন্দ্রাহত। ব্যালকনিতে ফিরে এলো সে। পিথাগোরাসের উপপাদ্যের সঙ্গে সম্পর্কের এই আজগুবি যুক্তিটা আসলে অনুরাগের নিজের আইডিয়া না। এটা তাকে শুনিয়েছিল একটা দিদি,কয়েক বছর আগে। একটা পিকনিকে। ব্যান্ডেলের একটা বাগানে তারা গেছিলো সেবার। ল্যাবের অ্যানুয়াল পিকনিক। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর মজলিস মত হয়েছিল,বেশিক্ষণ জমেনি সেটা। আস্তে আস্তে এদিক ওদিক অনেকেই ছিটকে গেছিল। তখন বাগানের একটা পুকুর পাড়ে বসে ওই দিদি,কি বেশ নামছিল,হ্যাঁ মনে পড়েছে, পারমিতা দি, এই আইডিয়াটা বলেছিল। বলাই বাহুল্য সেটা তৃতীয় জয়েন্টের পর। পিকনিক প্রায় শেষের দিকে। সন্ধ্যে নামছে নামছে। খুব মন দিয়ে সেদিন পারমিতা দি র সবকটা কথা শুনেছিল অনুরাগ। এমনকি বিশ্বাসও করেছিল হয়ত। পুকুরকে পিছনে ফেলে ঘাট থেকে উঠে আসার সময় খুব অস্ফুটে পারমিতা দি বলেছিল- আমরা সমান্তরাল ভালোবাসি অনুরাগ,রেললাইন,ওভারহেড তার... ডিসেম্বরের ঠান্ডা জমাট সন্ধ্যের ভেতর সেদিন নেশার জন্যেই হোক বা ভুল করে ,অনুরাগের পারমিতা দি র গলার স্বরটা খুব মায়াবী মনে হয়েছিল। পরের বছর পারমিতা দি বাইরে চলে গেলো পোস্টডক করতে। ফেয়ারওয়েল পার্টিতেও দারুন আড্ডা হয়েছিল। সবাই চলে যাওয়ার পর দুজনে হাঁটতেও বেরিয়েছিল ওরা। কত কত বিষয় নিয়ে বক বক করেছিল সেদিন। একটুও ক্লান্ত লাগেনি। 

আজ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অনুরাগ মনে মনে ফিস ফিস করে বলল-পারমিতা দি অনুভূতি হেরে যায় বলেই ভাষার জন্ম। সবাই সবাইকে বুঝে নিতে পারেনা বলেই ভাষার জন্ম। তোমার থিওরির বাতিল অতিভুজ  দিয়েই আসলে ভাষা তৈরি। আর কিচ্ছু না। 

খুব সুন্দর একটা ভোর হচ্ছে,সাথে আবার ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি নামলো বোধহয়। 

Tuesday 9 June 2020

ছাই রঙের শালিক

       ছাই রঙের শালিক 


ডানা ঝাপ্টাতে ঝাপ্টাতে একটা বৃষ্টিভেজা শালিক এসে বসলো কার্ণিশে। অনুরাগের ঠোঁটটা আনমনে কিছুটা চওড়া হল। এক শালিক দেখলে নাকি দিন খারাপ যায়, শালিকটার দিকে তাকালো সে, ছোট্ট কালো মাথাটা ভিজে একাকার। রোজ দুপুরে বৃষ্টি নামছে আজকাল। বৃষ্টি নামলে আর ভালো লাগে না অনুরাগের। আমফানের আপডেটগুলো দেখে বৃষ্টির ওপর আরও রাগ হয়ে যায় আজকাল। মাথাটা জানলায় অল্প হেলিয়ে ভেজা শালিকটাকে দেখতে লাগলো সে। চুপ করে বসেছে। 

-ওই ওই...ওই দেখ 
-কি? কি?
-দেখই না
-কোথায়?
-ওই যে...ওই যে রেলিং এ
-এক শালিক,বাহ্‌। জানতাম,আমি ঠিক জানতাম
-আরে এসব মানিস নাকি?
-না,কিন্তু তবু তুই এসব দেখাবি কেন?
-এক শালিকের কত কষ্ট বল
-অ্যাঁ?
-সিঙ্গেল
-সেই
-না সত্যি,লোকে ভাবে এক শালিক দেখলে দিন খারাপ যাবে,ভাব যে শালিক একা তার দিন হয়ত এমনিই খারাপ যাচ্ছে
-বটে, একা থাকা ভালো। শান্তিতে থাকা যায়
-আমি অশান্তির কারণ বলছিস?
-না, তুই অশান্তির কারণ এবং শান্তির উৎস
-বার খাওয়াস না। 
(মেঘ ডাকার একটা বিকট আওয়াজ শোনা যায় হঠাৎ) 
-আরে না সত্যিই...বৃষ্টি নামছে,ছাতা বের...ও তুই তো ছাগল ছাতা টাতা নিয়ে বেরোস না কোনোদিন...এদিকে আয়...ভিজিস না...

দুটো মানুষ একটা ছোট্ট শেডের তলায় নিজেদের গুছিয়ে নিলো আর ঠিক এই সময় শালিকটা উড়ে গেলো হঠাত,বৃষ্টি নামলো বলেই হয়ত।

চোখটা খুলে অনুরাগ ছাই রঙের আকাশের দিকে  তাকিয়ে দেখলো , শূন্যতার রঙ গ্রে। শালিকটাকে খুব চেনা চেনা মনে হল আচমকা। বৃষ্টির ছাঁট আসছে বলে জানলা থেকে সরে আসতে আসতে সে দেখল আর একটা বৃষ্টিভেজা শালিক এসে বসল। বৃষ্টিটা আরো বাড়ছে। শুধু আজ মেঘ ডাকছে না। 

অর্ধবৃত্ত,বাকি অর্ধ কোয়ান্টাম



অর্ধবৃত্ত,বাকি অর্ধ কোয়ান্টাম 


বায়োকেমিস্ট্রির একটাও অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট হয়নি অনুরাগের। দুটোয় ক্লাস,তার আগে লাইব্রেরিতে বসে ফাইনাল টাচগুলো দিয়ে নেবে কিভাবে সেই প্ল্যানিংটা করতেই করতেই হাওড়া স্টেশনের সাবওয়ে থেকে বেরিয়ে ইওয়ানের লাইনে দাঁড়ালো সে। চড়চড়ে রোদ মাথার ওপরে,তার সঙ্গে অফিসটাইমের অর্ধবৃত্তাকার বাসের লাইন,অনুরাগের লিনেন শার্ট পিঠে ক্রমশ চেপে বসছে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে হেডফোনটা সেট করে গান চালাতে চালাতে একটা সুগন্ধ অনুভব করলো সে। মাথ তুলে যখন দেখল তখন মেয়েটি অনেকটা পিছনে চলে গ্যাছে। ফোনের স্ক্রীনে চোখ সরিয়ে সদ্য সেট করা হার্ড রক থেকে অরিজিৎ সিং এ শিফট করে গেলো অনুরাগ। 
-দাদা,লাইন এগোচ্ছে
(অন্যমনস্কতায় স্থির হয়ে গেছিলো সে)
-(অপ্রস্তুতভাবে)...হ্যাঁ হ্যাঁ সরি;এগোলো সে। 
পনেরো মিনিটেই বাসের গেটে এসে সে টের পেলো মনের মধ্যে একটা কথাই বার বার রিপিট হচ্ছে,জানলাওয়ালা দুজনের সিটটা যেন পেয়ে যাই। বাস আধাআধি ভর্তি জানলার ধারে একটা সিট পাওয়া গেলো। কিন্তু বসার পর খেয়াল করল যে জাকির খানের প্ল্যানিং ফুলপ্রুফ,যদি মেয়েটি পাশে এসে বসে তাহলে বোনাস,নাহলে জানলার হাওয়া এই রোদ্দুরে কোনোদিন ধোকা দেয়নি আর প্লেলিস্টে গান তো রইলোই। ইচ্ছে করে ফোনে মুখটা গুঁজে রাখলো। আড়চোখে দেখলো মেয়েটি তার বন্ধুর সাথে কোণাকুণি তিনজনের সিটে বসলো। অনুরাগের সিট থেকে শুধু মেয়েটার মাথার একটু দেখা যাচ্ছে। 
-দাদা এখানে কেউ আছে?
-(আবার অপ্রস্তুতভাবে এবং অন্যমনস্কভাবে)...হুম...না না...কোথায় নামবেন আপনি?
-যাদবপুর
-এক কাজ করুন ভেতরে চলে আসুন,আমি হাজরা।
-আচ্ছা
জানলাটা ছেড়ে দিয়ে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলেও এখন মেয়েটার হাত দেখা যাচ্ছে। কি সুন্দর আঙ্গুলগুলো। তুঁতে রঙের সালোয়ারের ওড়নাটাও সিট থেকে খানিকটা ঝুলছে। মেয়েটি বন্ধুর সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা বলছে। অনুরাগ জানলার দিকে মুখ ফেরালো। বাস বড়বাজার পেরোচ্ছে,অনেক দেরি হাজরা আসতে। কানে হেডফোনটা লাগিয়ে অনুরাগ চোখ বন্ধ করলো। 

ঘুমটা যখন ভাঙলো তখন পূর্ণ সিনেমা এসে গ্যাছে। হেডফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ব্যাগ নিয়ে ধীরে ধীরে  গেটের কাছে এলো অনুরাগ। বাসের ভেতর গরে মুখের ওপর কিছুটা ঘাম জমেছিল,এখন গেটের কাছে মুখে হাওয়া লেগে সেগুল আসতে আসতে শুকিয়ে যাচ্ছে,ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে বেশ। মেয়েটি নেমে গ্যাছে আগেই কোথাও। সেই সিটে এখন একজন অফিসযাত্রী। 
বাস থেকে নেমে অনুরাগ অনুভব করল কি কি ফাইনাল টাচ দেবে ভেবেছিল সেগুলো সব গুলিয়ে ঘ হয়ে গ্যাছে। মুখ তুলে ইওয়ানটাকে চলে যেতে দেখল সে। এই বিরাট শহরে আর কোনোদিন এই মেয়েটির সাথে দেখাই হবে না হয়ত তার,দেখা হলেও সে চিনবে না,তার মুখ সে দেখতেই পায়নি। শুধু হাতের আঙ্গুলগুলো চেনে। আর একটা সুগন্ধ। মুচকি হেসে রাস্তা পেরিয়ে কলেজে ঢুকে গেলো সে।  

Monday 1 June 2020

3am








Wo fitoor wo kashmakash aur silsile se thukrate thukrate na jane kab dua taqdeer ho gayi

Bachpan Thodi si ruko kahe ke gayi thi
Hum to intezaar me maheer ho gayi

Jis nazare se dekh rha hu ab
Waha bahut vir ho gayi



Har ek roj har ek sham 
Har ek mayushi jo abhi ek chota sa pencil box me bandh hai
Kya karun main mera to bas yadoon se sambandh hai

Hum to chasmadid gwa hai us larke ka jo fiza me gum ho gayi
Kahte hai dhundoon to vagban mil jata hai mai to musafir ho  gayi
Duniya mukammal karne ki gunjaish leke nikle the, mai to gurbat me chir ho gayi
Jis nazare se dekh rha hu ab
Whan bahut vir ho gayi



Fiza me ranjishein bahti hai aur lautne ki tamanna ap ne ap hazir ho gayi

Yaadoon me kharch  hote hote na jane kab 
Sina ulfat me fakir ho gayi
Jis nazare se dekh rha hu ab
Wah bahut vir ho gayi








সবুজ বোতাম


                  


                     সবুজ বোতাম 

হাই পাঠাবো? এই প্রশ্নটা গত দু’দিন ধরে মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কি ভাব্বে? যাই ভাবুক,পাঠিয়ে দেখি? আমরা যারা হঠাৎ একা, যারা হঠাৎ এলোমেলো তাদের ভাবনা গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়ে। শেষমেশ একটা হাই পাঠালাম। উত্তর নেই। নিউ মার্কেট থেকে অল্প কিছু কেনাকাটা করে বাসে উঠলাম। আকাশে মেঘ, মেসেঞ্জারেও। নেটটা অফ করে রেখেছি। মেসেজ এলে? আসুক। কখন হাই পাঠিয়েছি, এত দেরি হয়? আমিও দেরি করে রিপ্লাই দেবো। বাসের জানলা দিয়ে হাওয়া আসছে, শহীদ মিনারের দিকে তাকালাম,কি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা আমরা কেন গাছের মত শান্ত হতে পারি না?বাসের জানলা থেকে আমি দেখেছি কলকাতায় সন্ধ্যে নামে, যেভাবে প্রেমিকার ঝুপ করে অভিমান হয়,তেমন। নাহ্‌,নেটটা একবার অন করি। অন করতেই টুং করে একটা মেসেজ। বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। প্রিয় পদটাকে যেমন আমরা খাওয়ার সময় বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে খাই, তেমন আমিও ফোনে অকারণ কয়েকটা কাজ করে মেসেজটা দেখলাম। “হাই”। মুশকিল হল এরপর কি বলবো? লিখলাম-কি করেন? এবার রিপ্লাই কিছুটা জলদি-এমএসসি কমপ্লিট। 
পিএইচডি করবেন? 
নাহ্‌।জব।
আচ্ছা। 
আবার কথা শেষ। ধুর এভাবে হয় নাকি? আমিই প্রশ্ন করে যাবো? লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম
বই পড়েন?
হ্যাঁ,খুবই।
সবরকম?
হ্যাঁ আমি সর্বভুকই! 
মনে মনে ভাবলাম যাক টপিক পাওয়া গ্যালো। টুং করে আবার একটা মেসেজ।
আপনার ভালো লাগে বই পড়তে?
এই প্রশ্নটা আমার জন্য লুজ বল,ছয় না মারলেই নয়।
বললাম- হুম,আমি পেটুক রিডার। 
আমার বাস ততক্ষণে হাওড়া ব্রিজে উঠে পড়েছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে শহরটাকে আরো একবার দেখলাম, এখন আর অভিমান নেই, হলুদ বাতিগুলো গয়নার মত লাগছে। 


ডিনার করে এসে একটা বই নিলাম পড়বো। হাইজেনবার্গ লোকটা বেশ ঝরঝরে লেখেন। বহুদিন পর কিছু লিখতে ইচ্ছে হল। কিন্তু সাবলীল লেখা এলো না। বইটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। ফোনটা চার্জ থেকে খুলে মেসেজ করলাম-
হাইজেনবার্গের এই বইটা পড়েছেন?
তার নামের নীচে তখন টেন মিনিটস অ্যাগো দেখাচ্ছে। ফোনটা রেখে দিয়ে আবার বইটা পড়ার চেষ্টা করলাম। বুঝলাম মনও ইলেক্ট্রনের মত ডুয়াল নেচারের জিনিস। এবং অনিশ্চয়তা নীতি মেনে তার অবস্থান আর ভরবেগ একইসঙ্গে নির্ণয় করা সম্ভব না। আমি ল্যাদ খেয়ে বসে রইলাম আবার। ঠিক যেই হাল্কা ঝিম ভাব এসেছে তখনই মেসেজটা এলো-
না তো। কি নিয়ে?
এটা ফিজিক্স এবং ফিলোসফি নিয়ে। খুব ভালো লেখা। পড়ে দেখবেন। 
আচ্ছা।তো আপনি কি স্টুডেন্ট? 
হুম।হয়ত সমবয়সীই হবো। 
(হঠাৎ খেয়াল হল আমার কিছু বন্ধু ওনার কমন ফ্রেন্ড। এই পরিচিতি গুলো জীবনে দৈব আশীর্বাদের মত নামে। আসলে আমি এন্ট্রপি প্রিয় মানুষ, ছড়িয়ে মাঠ ময়দান আমার অন্যতম প্রতিভা, কিন্তু হঠাৎ খুব গোছনো হলাম। ধীরে এগোতে হবে।)
আমায় আপনির থেকে তুই বললেই খুশি হই তাহলে।
শেষের কবিতায় অমিত লাবণ্যকে বলেছিল বেগ দ্রুত করতে হলে বস্তু কমাতে হয়, তাই অমিতবাবু নয়, শুধু অমিত। 
আমি অমিত নই, কিন্তু অপরজনকে লাবণ্য ভাবতে দোষ কোথায়? গল্পের গরু গাছে ওঠে আমি বুর্জ খলিফায় তুলে দিয়েছি। 
বললাম-বেশ। তুইই বলবো। 
ব্যাপার হল আপনির মধ্যে যে দূরত্বটা আছে ‘তুই’ তে সেটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। কেন? এটা অনেকটা অন্য ডিপার্টমেন্টের মেয়ের প্রেমের পড়ার মতন। তবে আসল কথা হল ‘তুই’ থেকে ফ্রেন্ডজোনের দূরত্ব খুব কম।   

আমি জিজ্ঞেস করলাম- পিএচডি করবি না কেন?
নাহ্‌,ইচ্ছে নেই। তাও একবার নেটটা দেবো। 
আচ্ছা, দেখ ট্রাই কর। 
কথায় কথায় আমি যে একটু আধটু লিখি তা বলা হল। তারপর হঠাতই দেখি আর কোনো রিপ্লাই নেই! আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম রাত দেড়টা। ঘুমিয়ে পড়ল? এমন আচমকা? আমি নিজেকে রেক্টিফাই করে নিচ্ছি শুধু মন নয়, মেয়েরাও হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি মেনে চলে। আচ্ছা প্রকৃতি কি মেয়ে? এরকম মাঝরাস্তায় ঘেঁটে দেয় কেন? কোয়ান্টামটা জানতে দিল, অথচ বুঝিয়ে দিল যত জানবো তত ঘেঁটে যাবো। আড়ালে বসে এই মুচকি মুচকি হাসিটা প্রকৃতির ধর্ম,মেয়েদেরও। 

আমি ফোনটা রেখে বসলাম লিখতে। একটা সামান্য চিঠি। সময়ের সাথে সাথে কথায় কথা বাড়তে বাড়তে যখন আমার সব দোষ ত্রুটি ধরা পড়ে যাবে, যখন আমি আড়াল পাবো না, তখন এই চিঠিটাকে ঢাল করবো এমনটাই উদ্দেশ্য। 

ধরো তোমার নাম ‘কিচ্ছু না’, অথচ সবকিছু! 
এ চিঠির প্রথমেই যে দ্বিধা এসে পড়ল তা হল সম্বোধন কি বলে করা উচিত,অন্তত চিঠির মধ্যে-‘তুই’ না ‘তুমি’? মুশকিল হল আমার কাব্যঢং,আমার স্বাভাবিক নাটুকেপনা আমাকে ‘তুমি’ বলতে জোর করে,আমার বাস্তবতা আমাকে ‘তুই’ বলতে বাধ্য করায়।ঠিক যেমন মেয়েদের সাজ,প্রয়োজনকে তুচ্ছ করে যেখানে ইচ্ছা বড় হয়ে উঠেছে,তাতে যেমন জাহির করার দোষ আছে তেমনই দর্শকের চোখ জুড়িয়ে দেওয়ার তৃপ্তি।না সাজলেও তাদের চলে যেত,কিন্তু আমাদের চলত না।এ তাদের স্নেহ,আমাদের দৃষ্টির অক্ষমতা।তাই মানুষটি না চাইলেও তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে বিরম্বনায় ফেলা এক স্বভাব,এখানে তার চেয়ে নিজের স্বার্থ বেশি। আমি এই দুইকেই অস্বীকার করতে পারি না। কারন যে ভাষায় কাছের মানুষ ধরা দেয় সে ভাষা ভালো ভাষা, শ্রেষ্ঠ ভাষা নয়,বরং যে ভাষায় আমি আড়াল পাই,যে ভাষা আমাকে সময়মত লুকিয়ে পড়ার অবকাশ দেয় তাই শ্রেষ্ঠ ভাষা। কাছের মানুষের কষ্ট কখনও কখনও নিজের থেকেও বেশি বুকে বাজে,আর ঠিক সেই কারনেই যা কিছু সত্যি তাই সবসময় সঠিক নয় সম্পর্কে, মিথ্যেও সঠিক হয়ে ওঠে।বিজ্ঞানীদের কাছে খাটি সোনা এক জিনিস,আর স্যাকরার কাছে আরেক। বিজ্ঞানী শুদ্ধতাকে তুলে ধরতে চায়, আর স্যাকরা মজবুতি। তাই স্যাকরা খাদ মেশায়। আমি বলি সম্পর্ক স্যাকরার কৌশলেই চলা ভালো,কেননা সে মজবুতির খাতিরে খাদ মেশায়, শুধুমাত্র শুদ্ধতার খাতিরে তাকে বিরক্ত করে তোলে না। 

 “ঘরে বাইরে” উপন্যাসে নিখিলেশ এক জায়গায় বলেছেন-‘আমার মনের বোধশক্তি হঠাৎ এমন ভয়ানক বেড়ে উঠেছে যে,যে দুঃখ আমার অতীতের বুকের ভেতর সুখের ছদ্মবেশ পরে লুকিয়ে বসেছিল তার সমস্ত মিথ্যা আজ আমার নাড়ি টেনে টেনে ছিঁড়ছে;আর যে লজ্জা যে দুঃখ ঘিনিয়ে এলো বলে,সে যতই প্রাণপণে আমার হৃদয়ের সামনে ততই তার আবরু ঘুচে গেল। আমার সমস্ত হৃদয় দৃষ্টিতে ভরে গিয়েছে-যা দেখবার নয়,যা দেখতে চাই নে,তাও বসে বসে দেখচি’। এর মধ্যে একটা গভীর অসহায়তা প্রকাশ পেয়েছে,তা শুধু নিখিলেশের নয় তা সারা বিশ্বের সমস্ত প্রেমিকের অসহায়তা।এখানেই রবি ঠাকুরের সার্থকতা। নোলানের “ব্যাটম্যানঃদ্য ডার্ক নাইট” সিনেমায় জোকার বলেছিল যে সমাজের ভালো মানুষগুলোকে যে মুহুর্তে তাদের ভালো পরিবেশের বাইরে নিয়ে যাবে,সেই মুহুর্তে সে তার ভালোমানুষির মুখোশ খুলে বেরিয়ে আসবে। আর তাই আমি বলি ঝগড়া আমাদের বিচ্ছেদ নয়,বরং গভীর মিলনের ছল। ঝগড়া আমাদের ভেঙে ফ্যালে না, আমাদের আরো শুদ্ধতায় গড়ে তোলে। লেখকের ডাস্টবিনে যা কিছু বাতিল, তা কিন্তু আসলে পরিণত লেখাকেই আরো পরিণত করে। তাই শুদ্ধতার জন্য যাচাই  করে নেওয়া জরুরী। তবে কিনা প্রেম সবসময় শুদ্ধতার ভিখারি নয়,বরঞ্চ একটু অশুদ্ধতা,নষ্টামি এইসবও সে চায়। অর্থাৎ কিনা গুরুদেবের ভাষায় প্রেম শুধু অক্সিজেনে শ্বাস নেয় না, আগুনও জ্বালায়। টেরাকোটার মূর্তির গায়ে তার পোড়া দাগ তারই সৌন্দর্য্যের প্রতীক,তার লজ্জা নয়। প্রেমের চোখে কান্নাকাটির দাগ তেমনই এক সৌন্দর্য্যের প্রতীক,তা অস্বীকারের নয়। প্রেম জবা নয়,গোলাপ ফুল চায়। ভক্তি নয়, ভালোবাসা চায়। এই ভালোবাসা আস্তে আস্তে আমাদের মনে জাঁকিয়ে বসে ওদিকের মানুষটাকে নিজের দিকে টেনে আনে।এবং সময়মত তার ওপর অধিকার ফলায়। এতে দোষ অধিকারীর,প্রেমের নয়। প্রেম কোভ্যালেন্ট আর আয়োনিক হতে পারে,নন-কোভ্যালেন্ট হতে পারে না। কোভ্যালেন্ট হল দুপক্ষের প্রেম, আয়োনিক হল দুটি বিপরীত ধর্মের প্রেম,তাদের যা কিছু অমিল তাই যেন তাদের শক্তি। কিন্তু নন-কোভ্যালেন্ট হল ভালোবাসা,প্রেম নয়। আমাদের হল আয়োনিক প্রেম। 
প্রথমেই বলি প্রেম খানিকটা যোজ্যতার মত,সে বাইরের কক্ষের জৌলুসেই আসক্ত হয়। তড়িৎযোজ্যতায় এক স্বাভাবিক প্রবণতা আছে ল্যাটিস শক্তি নির্গত করার। দৃঢ় কেলাস গঠন করে একসাথে থাকা,এবং যা কিছু বাধা সমস্ত জালক শক্তি রূপে বের করে দেওয়া। কিন্তু মৌল যেভাবে গঠিত হয়,সম্পর্ক সেভাবে গঠিত হয় না। কেননা তড়িৎযোজী বন্ধনে দুটি মৌলের মন নেই,প্রকৃতির যা নিয়ম তা তারা চ্যালেঞ্জ করতে পারে না, কিন্তু সম্পর্কের দুটি মানুষ তা পারে। এবং তা পারে বলেই সম্পর্কের নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। 

পুনশ্চঃ এই চিঠি আসলেই আমাকে ব্যাখ্যা করে।কিন্তু এই চিঠির অক্ষমতা যে এই চিঠি শুধুই আমার দৃষ্টিতে লেখা। আর ঠিক এই কারনেই আমি এর পালটা চিঠি দাবি করছি,অপর দিকের মানুষটার চোখে আমি কেমন তা বোঝার এবং জানার খাতিরে।   

পরেরদিন রাতের দিকে যখন আমার টাইমলাইন তোলপাড় শব্দের খেলায় একটা ছোট্ট মেসেজ এসেছিল-
একটু শান্ত হ! আমিও হই। 
আমি তো জানিই চিনচিনের একটাই ঠিকানা, মনকেমনের ভেক্টর নেই। শান্ত হবো? আমি তো নোবেল গ্যাস নই? আমি তো ডাবল বন্ডে পূর্ণ আনস্যাচুরেটেড মানুষ। আমি তো দুঃখকে শূন্য দিয়ে গুন করা মানুষ। আজ হঠাৎ এক দিয়ে গুন করে ফেললাম কেন?   

Friday 29 May 2020

নীল


নীল

এসো,কিছুক্ষণ বসি,
শান্ত ছায়ায় সবুজ জলের সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসি। 
কথা তো নেই, সমস্ত অপারগ চোখ নীল করে ফিরে গ্যাছে বহুদিন,
কথা নেই। 

হয়ত জল কেঁপে উঠবে এক দু’বার, পাতাও নড়ে উঠবে 
জল পড়ে পাতা নড়ে ...সেই ছোটোবেলায় মনে নেই?
মনে তো নেই কয়েকবছর আগের কথাও, মনে তো নেই 
কত কত নীল মিলিয়ে গ্যাছে চামড়ায়। তাতে কি?
কিছুক্ষণ কি বসা যায় না ?
সময় তো কারোরই নেই। তাই বলে নৌকায় বসে এপাশ ওপাশ দেখবো না? বলো? 
সাধারণই হল নাহয় এই বিকেলের হাওয়া, খুব সাদামাটাই হল নাহয়
আকাশ। সম্পর্ক কি পাহাড়ি কোনো গ্রাম? হঠাৎ হঠাৎ এত কুয়াশা জমে কেমন করে বলোতো? আবছা দেখায় তোমার লাল পাড় সাদা শাড়ি,তাতে কালো শাল। এমনকি এই আবছায় বিশ্বাস করে এগিয়ে গেলে খাদ,সেটাও। দেখেছো উপমা দিতে গিয়ে আমি কত সাবলীল হয়ে যাই,
তবু যে কেন আমি কথা পাচ্ছি না, আচ্ছা তোমার কথা বলবে কিছু?

-কথা ছাড়া কি বসে থাকা যায় না?
-যায়,খুব যায়। যদি থাকো,তাহলে যেতেই হবে। তুমি চলে যাওয়ার পর আমি ইংরেজি গান শুনলাম অনেক,আগে তেমন শুনিনি। তোমার শেষেরর দিন গুলোয় তোমাকে ডুবে থাকতে দেখেছি আমি এই গানে। হয়ত সবকটা নয়,তাও মনে করে করে কিছু গানের ভেতর দিয়ে আমি তোমার কাছে পৌঁছেছি, যেন ধাঁধা সমাধান করছি। 

আর কিছুক্ষণ যদি দাঁড়িয়ে যেতে হয়ত, হয়ত...
-আর কিছুক্ষণ বলে কিছু হয়না, মেনে নাও। জানি সময় লাগবে। 
-হ্যাঁ হ্যাঁ, এমা এভাবে বোলো না, মেনে নিচ্ছি তো। আমার কথা বাদ দাও। ঠেকায় পড়ে মানুষ সব শিখে নেয়। তোমার নতুন মানুষের কথা বলো? 
-সেসব শুনে কি করবে? থাক না সেসব।
-থাকবে? 
-থাকুক।
-সেই ভালো। একি উঠলে?
-হ্যাঁ, যেতে হবে এবার। সামলে ওঠো। 
-হ্যাঁ এমা, সেতো...

গাছের পাতার আওয়াজ, জলের মৃদু তরঙ্গ, আমার কিছু নেই আর।
তুমি যাও। আমি কিছুক্ষণ বসি। হাওয়া দিচ্ছে ভালো লাগছে বেশ। 

এসো। 
আমি কিছুক্ষণ আরো বসি। 
এখন আমি নিজেই আকাশ, এত নীল দেখছো না!  

Sunday 23 April 2017

রেমন্ড জে সেগার তাঁর “প্ল্যাঙ্ক,ফিজিসিস্ট”1 প্রবন্ধ শুরু করছেন এমনভাবে যা পড়ে মনে হয় হয়ত আকস্মিকভাবেই প্ল্যাঙ্ক একজন পদার্থবিদ হয়ে গেলেন,যিনি আদৌ কোনোদিন ভাবেননি বিজ্ঞানের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব চমকে দেবেন।“দ্য সেকেন্ড ক্রিয়েশনঃমেকার্স অফ দ্য রিভলুশন ইন টুয়েন্টিন্থ সেঞ্চুরি ফিজিক্স”2 গ্রন্থে প্ল্যাঙ্ককে কনসারভেটিভ বৈজ্ঞানিক বলা হচ্ছে,এর সঙ্গত কারনও আছে।যারা জে এল হিলরনের “ডিলেমাস অফ অ্যান আপরাইট ম্যান” পড়েছেন তারা হয়ত রোববার দুপুরে তর্ক জুড়তেই পারেন প্ল্যাঙ্ক কতটা ঝুঁকেছিলেন ধর্মের দিকে। যেখানে গুগল সার্চ করলে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ককে দশটার মধ্যে অন্তত তিনটে ওয়েবসাইট থাকবে যেখানে আদ্যপান্ত ধর্মীয় মানুষ হিসেবে দেখানো হবে সেখানে আদৌ কতখানি তর্কের জায়গা আছে তা নিয়ে সংশয় থাকতেই পারে,কিন্তু তবু কেন তর্ক করবো যে ওই যুগে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়েও প্ল্যাঙ্ক একজন স্বতন্ত্র মানুষ ছিলেন তার একটা কারন বলি। সেগারের প্রবন্ধে এক জায়গায় প্ল্যাঙ্কের সাথে চার্চের বিরোধের একটা তথ্য দেওয়া আছে,যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় প্ল্যাঙ্ক ধর্মে বিশ্বাসী হলেও তাকে একদমই অন্ধভক্তিতে পরিণত করতে চাইতেন না। এ কেমন কথা হল?এই ব্যাপারটা কেমন তা একটু পরিষ্কার করি।দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী “বইয়ের দেশ” এ একবার এক সাক্ষাৎকারে3 সুমন সেনগুপ্তকে বলেছিলেনঃ “তুমি মার্ক্সের মধ্যে তত নাস্তিকতা পাবে না,যতটা তুমি সংস্কৃতে পাবে।এসব জানা দরকার।সেসব জেনে আস্তিক হও। বন্ধুবর শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়-আস্তিক কাকে বলে? কাকে বলে নাস্তিক?-এ নিয়ে চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছেন......আমি তো ঈশ্বর মানি।কিন্তু আমি এসবও জানি।ফলে আজ যদি একজন নিরীশ্বরবাদী কেউ আমার সামনে আসেন,আমার তাঁকে দেখে ভয় করে না......বরং আমি তাকে ওয়েলকাম করি।তার কারণ,আমি তাঁদের দিকের যুক্তিটাও জানি।” আমার মতে এ ধারণা বোধহয় ক্ষতিকারক নয়,তর্ক থাকতেই পারে বা তর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক,কিন্তু সেই যুগে প্ল্যাঙ্কের কয়েকটি কাজ এবং বক্তব্য আমাকে ভাবতে বাধ্য করায় যে উনি অন্ধভক্ত ছিলেন না,এবং শুধুমাত্র হাইলাইট করা বক্তব্যগুলোয় আমি মানুষটিকে বিচার করতে রাজি নই।মনে রাখা প্রয়োজন প্ল্যাঙ্ক এবং বর্ন-হেবার সাইকেলের আবিষ্কারক ফ্রিৎজ হেবার ১৯২০ র অক্টোবরে “ইমার্জেন্সি অর্গানাইজেশন অফ জার্মান সায়েন্স” প্রতিষ্ঠা করছেন,যা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে লিপ্ত হয়, ঠিক এই সময় ওয়েস্ট জার্মানিতে নার্নস্ট আর রুবেন যারা জেমস চ্যাডুইকের শিক্ষক ছিলেন,রুহ্‌বেন ডিটেনশন ক্যাম্পে ছাত্রদের ল্যাব তৈরির জন্য লড়ছেন যুদ্ধপরবর্তী সময়ে।4মজার ব্যাপার এই মানুষটাই নাকি ১৯২০ থেকে আমৃত্যু এক চার্চের ওয়ার্ডেন ছিলেন।

কোয়ান্টাম স্টোরিঃ ১৮৯০ এর শেষদিক থেকে মোটামুটি ছ’বছর ম্যাক্স গবেষণা করেছেন আলো বিকিরণের ওপর।তাদের গতিপ্রকৃতির ওপর।১৮৯৪ এর পর তার আগ্রহের তালিকায় প্রবেশ করছে “ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশন”, তার দুবছর পর ১৮৯৬ এর ৭ই জানুয়ারি পঁয়েকার একজনের ভাঙা হাতের এক্সরে ফোটোগ্রাফ পান ডাক মারফত,ছবিগুলো পাঠিয়েছেন উইলহেম কনরাড রন্টজেন,যিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন এক্সরে।সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ,জে জে থমসন নামক একজন ইংরেজ বিজ্ঞানী সম্ভবত ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে ঠিক এই সময় আবিষ্কার করেছেন এক নতুন জিনিস, “ইলেক্ট্রন”।১৯০০ সালের ১৪ই ডিসেম্বর জন্ম নিচ্ছে “চাইল্ড অফ দ্য সেঞ্চুরি”- “কোয়ান্টাম”। কেমন ছিল আবিষ্কারের দীর্ঘ পথ? ১৯১৮ সালে স্টকহোমে নোবেল পুরষ্কার নিতে উঠে ম্যাক্স বলছেনঃ “Looking back over past twenty years to the time when the  idea of the physical quantum of  action and the measurement of it, first emerged into definite shape from a mass of experimental facts, and looking back beyond that over the long and labyrinthine path of which finally led to the discovery.”কোয়ান্টাম থিওরি পদার্থবিদদের এতটাই নাড়া দিয়েছিল যেন প্ল্যাঙ্ক এপিমেথিউসের মত কোনো এক প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছিলেন,খুলে দিয়েছিলেন এক নতুন পথের দিশা।কিন্তু মজার ব্যাপার প্ল্যাঙ্ক নিজের থিওরি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না,ভাবনা চিন্তার পর তিনি আরো অপছন্দ করতে শুরু করলেন এই নতুন আবিষ্কারকে। কোয়ান্টাইজড শক্তির কথা তার একটু খটকা লাগছিল,কারন তিনি কিছুতেই নিজেকে প্রমান করতে পারছিলেন না। প্ল্যাঙ্কের মৃত্যুর পর তাঁর ছাত্র জেমস ফ্রাঙ্ক বলেছেন তিনি ক্রমাগত বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রমান করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন,এমনকি একসময় তিনি কোয়ান্টাম থিওরিকে পাশে সরিয়ে রাখার চেষ্টাও করেন,কিন্তু অবশেষে তিনি স্বীকার করেন এবং প্রমান করেন কোয়ান্টাইজড শক্তির তত্ব। কিন্তু এই তত্ব যে ছড়িয়ে পড়বে বিভিন্ন শাখায় তা নিজেও মেনে নেন। কিভাবে ছড়িয়েছিল তা?আইনস্টাইন যখন ফোটন কণার ব্যাখ্যা দিলেন তখন কোয়ান্টাম থিওরি তাকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করল। চার্লস ম্যান এবং রবার্ট ক্রিজ মজা করে বলেছেন হয়ত কোয়ান্টামের আবিষ্কারকের থেকেও বেশি জরুরীভাবে এই থিওরিকে গ্রহণ করেছিলেন আইনস্টাইন। তাই জেমস মার্ফি প্ল্যাঙ্কের “হোয়্যার ইস সায়েন্স গোইং”5 অনুবাদ করার পর যখন ১৯৩২ নাগাদ এক সাক্ষাতে আইনস্টাইনকে অনুরোধ করেন তার বইয়ের ভূমিকা লিখে দিতে তখন বিনয়ী অ্যালবার্ট বলেন যে কোয়ান্টাম থিওরির আবিষ্কারকের মনে হয়না তাঁর মত “লেসার লুমিনারি অব্জেক্ট” দ্বারা আলোকিত হওয়ার দরকার আছে। আবার আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি যখন বেরচ্ছে তখন সমগ্র বিশ্বে যে গুটিকয় মানুষ তার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। অবশ্য এই আন্তরিকতার কারন যে শুধুমাত্র পারস্পরিক পিঠ চাপড়া চাপড়ি নয় তা বলাই বাহুল্য।
শেষ করব এক বাঙালির কথা দিয়ে। ১৯২৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বোস যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের অধ্যাপক তখন ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের সাহায্য ছাড়া প্ল্যাঙ্কের রেডিয়েশন ল এর ওপর একটা পেপার লেখেন।উনি যে পথে এই কাজ করলেন তাকে আমরা এখন কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিকস নামে চিনি!

টীকাঃ
1.http://www.asa3.org/ASA/PSCF/1985/JASA12-85Seeger2.html
2.The second creation: Makers of the revolution of Twentieth century Physics by Robert P. Crease and Charles C. Mann
3.জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৪ সংখ্যা।অরিন্দম চক্রবর্তী সাক্ষাৎকার
4.Brighter Than A Thousand Sun  by Robert Jungk
 5.Where the science is going by Max Planck
Translated by James Murphy

শুভ জন্মদিন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক!