স্টাডিরুম নয়,চিলেকোঠা থেকে বলছি
ইদানীং জানলার পাশে বিকেল পড়ে আছে দেখলে আমার খালি মনে হয় আমরা কি সিরিয়াল
দেখতে দেখতে ক্রমশ একটা সিরিয়ালের সংসারের ভেতর ঢুকে যাচ্ছি?হ্যাঁ সিরিয়ালেই তো
সংসারে কালো মেঘ নেমে আসতে দেখানোর হলে গোধূলি দেখায়......আমাদের বসার ঘরে আমরা
গরম দুপুরেও কার্পেট পেতে রাখছি শুধুমাত্র গেস্ট আসবে বলে?(আমরা এখন অতিথি বলি
না)ছোটো কাকিমার সেজো ভাসুরের ছেলেকে আমরা নাটের গুরু ভাবছি সাংসারিক
ঝামেলায়?ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ লাগলে আমরা বলছি মহাসোমবার!অতঃপর আমরা স্টেডিয়ামের
বাইরে দাঁড়িয়ে “আইপিএল...আইপিএল” করে চেঁচাচ্ছি,ফলত,প্রতিটা সংসারে তৈরি হচ্ছে
নিত্যনতুন চিত্রনাট্য।আর যেহেতু চিত্রনাট্যের বাজার এখন গরম,তাই টিআরপির’ হিসেবে
প্রতিটা সংসার এখন হিট। কোনো ব্যাকস্টোরি নেই তাও আমার মনে হয়,বছর তিরিশ
আগেও,আবাসনের জানলাগুলোয় বোরিং সংসার থাকত,কোনো গল্প ছাড়াই এক একেকটা সংসার একদিন
বদল হয়ে যেত একটার পর একটা ভাড়াবাড়িতে..প্রায় প্রত্যেকটা বাড়িতেই মিশে থাকত একটা
ধকল,অ্যাডজেস্টমেন্টের ধকল। আর তাই আমরা এখনও কখনও কখনও চা বা কফির আড্ডায় শুনতে
পাই গল্প শুরু হয়-‘আমরা যে পাড়ায় থাকতাম’...কত কত্ত পাড়া এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে
বিকেলের পড়ন্ত রোদের ক্রিকেট খেলায় শেষবেলার দু’ বলে চারের ভেতর। “ইয়ে জওয়ানি
হ্যায় দিওয়ানী” সিনেমায় একটা ডায়ালগ ছিলো-‘...বিত্তা স্যময়,অউর খর্চ হাম হোতে
হ্যায়...’-হ্যাঁ ব্যাপারটা মিথ্যে কি?সত্যিই তো একের পর এক পরত সরতে সরতে আমরা
ক্ষয়ে যাচ্ছি সময়ের স্রোতে।কিন্ত তবু...
চোখ বুঝলে দেখছি...একটা নাড়ুর বয়ামে ঢুকে পড়েছি,বাইরে আমার হিন্দী টিচার
ঠাকুমা সিরিয়ালে পটল দেখতে দেখতে চেঁচাচ্ছে –বোওওউমাআআ...দেখো ছেলেটা নাড়ু খেতে কি
ভালোবাসে...মা,রুটির চাটুর ওপর গরম খুন্তিটা রেখে দৌড়ে এসে বলছে-দেখেছো,ওরে পেট
কামরাবে...আমি বয়ামের দেওয়ালে ঠোক্কর খেয়ে ফিরে ফিরে আসছি একই বিন্দুতে,যেভাবে
সমস্ত মানুষ অফিস ফেরতা ঘরে ফিরে আসে ক্লান্ত শ্রমিকের মত...সমস্তকিছু এত ছোটো যে
বারবার চেনা জিনিস দেখতে দেখতে ভুলে যাচ্ছি অচেনার ফারাক...এরইমধ্যে জেঠু অফিস
থেকে ফিরে আসছে হাতে ফুলের প্যাকেট,তাতে গাঁদা ফুলের মালা আর কুঁচো ফুল...আমাদের
গ্যারেজঘরে সাইকেল তুলে দিয়ে লাল রক দিয়ে হেঁটে আসার সময় আমার কংগ্রেস করা জেঠুকে
পরাজিত সৈনিকে মত লাগে...।জুতো খুলতে খুলতে জেঠু ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়ছে,আর আমি
শুনতে পাচ্ছি ঘরের ভেতর থেকে বড়মা বলে উঠছে-কমপ্ল্যানটা এনেছো?...বয়ামের
দেওয়ালগুলো এত মসৃণ যে আমি স্লিপ খেয়ে নেমে আসছি বারবার...ঠিক যেমন ছোটোবেলায়
স্লিপ খেতাম পার্কে...দাদু হাত ধরে নিয়ে যেত পার্কে...তখন ফেরার পথে ছ’ফুট লম্বা
দাদুর কাঁধের ওপাশে সূর্য ডুবে যেত...দাদু ফেরার পথে দাঁড়িয়ে পড়ত চপের
দোকানে...ফুলুরি...আলুর চপ...কতরকম অপশন...তারপর ধীরে ধীরে মানুষের জীবন যেরকম
এমসিকিউ এর চারটে অপশনে বন্দী হয়ে যায়,সেরকমভাবেই আমার গোঁফ গজালো...বয়ামের মেঝেতে
দুড়ুম করে ঠোক্কর খেলুম,টন টন করছে মাথাটা...ঠিক এইসময় বাথ্রুম থেকে বেরিয়ে জেঠু
খাদির পাঞ্জাবী পড়ে বেরোলো পার্টি অফিসের
দিকে...তারপর একটা পর একটা মিছিলে আর পাঁচটা পাঞ্জাবী পড়া পার্টিকর্মীর মত মিশে
যেতে লাগলো...জেঠুর গলার স্বর স্লোগানে স্লোগানে ভেঙে যেতে লাগলো...আর তারপর
সন্ধ্যে নেমে আসতে লাগলো আমাদের দেড়শো বছরে পুরোনো বাড়ির চুনসুরকির দেওয়ালে
দেওয়ালে...শাঁখের আওয়াজে ভেসে যেতে লাগলো আমার হোমওয়ার্কের সন্ধ্যে...এরইমধ্যে
হঠাতই দিদি বেরিয়ে এলো একটা টেডি বিয়ারের কোলের ভেতর থেকে,এসে বলল-রান্নাবাটি
খেলবি? আমি ভ্যাবলার মত ফিকফিক করে হাঁসলাম...এখন দেখতে পাচ্ছি দিদি বয়ামের বাইরে
থেকে আমাকে দেখতে পেয়েছে কিন্তু যেহেতু এখন আমাদের আর জেঠুদের মাঝে বর্ডার বর্ডার সিজন
চলছে,তাই দেখতে পেয়েও দিদি বেরিয়ে যাচ্ছে ফোন বাজছে বলে...আমি জানলার দিকে তাকিয়ে
দেখছি দিদির মত হাজার হাজার কমলা সালোয়ার পরা মেয়ে কানে ফোন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে
কোচিং কলেজের দিকে...দাদুর দম দেওয়া ঘড়িতে ১১ টা বাজলে বাবার বাইকের শব্দ শুনতে
পাই...বাইকের ওপর বাবা একটু একটু দুলছে...বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে মা কড়া নজর দিয়ে
ফিরে যাচ্ছে ঘরের দিকে...আমি দেখছি বাবা বাইক তুলে দিচ্ছে আসতে আসতে...বয়ামের ভেতর
এখন বদ্ধতা বাড়ছে...আমাদের বারান্দায় যে হলুদ ডিম লাইটটা জ্বলে তার ছায়ায় বাবাকে
তেজি ঘোড়ার মত ফিরে আসতে দেখছি খাবার টেবলে...উঁহু টেবল নয়,আমরা বরাবর মাটিতে বসে
আবু বাবু হয়ে খেতাম,পরের দিকে দাদুর হাঁটু ভেঙে যাওয়ার পর দাদু টেবলে বসে
খেত...দাদু হঠাৎ বলে উঠছে-ইলিশটা কেমন? আমি,যে কিনা ইলিশ জন্মেও ভালোবাসতাম না,সে
এখন দিব্যি চাপালজ্জায় ভাপা ইলিশ মেরে দিচ্ছি...দূরে কোথাও-‘...একদিন আপ ইঁউ হামকো
মিল জায়েঙ্গে...’-বেজে উঠছে...প্যান্ডেলের পর প্যান্ডেলে নচিকেতার “বৃদ্ধাশ্রম”
বেজে চলেছে সারা সন্ধ্যে...রাতের দিকে রফি চালাচ্ছে মাঝে মাঝে...একটা পর একটা নতুন
গজানো এগরোলের দোকান ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে...ঠাকুর দেখে ফিরে আসছে পরিবারএর পর
পরিবার...সপ্তমীতে প্রত্যেকটা পাড়ায় মধ্যরাতের দিকে স্বস্তি নেমে আসে,কারন মা এখনও
দিন তিনেক আছে...এছাড়াও পরেরদিন অঞ্জলী তাই পাড়ার সমস্ত যুবতী সেদিন লাল পাড় সাদা
শাড়িতে ঈশ্বরী হয়ে উঠবে...অতএব ভোরের দিকে চারদিক ছেয়ে যাবে শুভ্রতায়...
আর আমরা জানি একটা পচা আপেলের ঝুড়ির ভেতর বাকিসব ভালো আপেল....কনসিকোয়েন্টলি একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে উঠে পড়ছে ফ্ল্যাট...কর্পোরেশন যেহেতু ইস্তেহারে লিখেছে- যুদ্ধ নয় শান্তি চাই‚ঐক্যই আমাদের লক্ষ্য....সেই অ্যাজেন্ডা
অনুসারেই আবাসনে আবাসনে বৈচিত্রের মধ্যে ভারতবর্ষ গড়ে উঠছে...যেভাবে ক্ষতর ওপর থেকে ব্যান্ডেড তুলে নিই‚সেভাবে লেখার ভেতর থেকে লাইন তুলে নিয়েছি আর বাতিল সেলোটেপের মত ছুঁড়ে ফেলে দিতে গিয়ে হাতে পেঁচিয়ে উঠেছে ব্যাথা আর ঘরের কোনে আগুন...আগুন.....রাস্তার দু'ধারে যারা প্রতিবাদ করবে বলে এসে দাঁড়ালো তাদের আমি প্রায় পাখিপড়ার মত করে বুঝিয়ে বললাম যে আসলে সাম্যবাদ ছাড়া গতি নেই তাই অগত্যা বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এই মিছিলে লোক বাড়াতে হবে আরো..বাড়িয়েই যেতে হবে...একদিন সমস্ত মিছিল শুরুর দিক থেকে উবে যেতে যেতে শেষপ্রান্তে নুইয়ে পড়া যে লোকগুলোর সামনে এসে দাঁড়ালো তারা
জন্মে কোনোদিন মার্ক্স পড়েনি...তবু তারাই আজ দলবদলের খেলায় পার্টি বদলালো না...কিন্তু না আমি যে গল্পটা বলবো বলে শুরু করেছিলাম সেটা জ্যাকেটের ভেতর জমে যাচ্ছে...শীত শীত করছে তাও...বাবুঘাট থেকে অফিস ফেরতা টাইমে সমস্ত লঞ্চ স্বর্গের দিকে যায় বলে আমি সেই...একইরকম গতানুগতিক শহরে ফিরে আসছি...
এসে পড়ছি একটা কুম্ভীপাকের মধ্যে...নীল নীল কড়াইয়ের ভেতর ডুবে যাচ্ছে বেগুন ভাজা...লুচির গন্ধে ভরে যাচ্ছে আমাদের বাড়ি...মেঘলা আকাশের নীচে আমার জেঠু বিয়ে করতে যাচ্ছে দ্বিতীয়বারের জন্য...হ্যাঁ একদিন জেঠিমা কমপ্ল্যানে খেতে খেতে অনেকটা লম্বা হয়ে আকাশে উঠে পড়ল যেভাবে গল্পের গরুরা একদিন গাছে উঠে পড়ে ভেঙে পড়া বাসরের জানলায়‚সূর্যের প্রথম আলোয়...আর তারপর থেকে শুরু হয়ে যাচ্ছে হাইওয়ে..আমরা যাচ্ছি কালিপূজোর বাজি নিয়ে দাদুভাইয়ের বাড়ি...সেখানে কালিপুজো হয় প্রতিবার...দাদুর বাড়ি
মফস্বঃলে...সেখানে জমিয়ে ঠান্ডা পড়ে...প্রচন্ড বাজির শব্দে আমরা পাঁজরে পাঁজর ঠেকে যাওয়ার শব্দ লুকিয়ে রাখছি ...অথচ নিজেরাই অস্থির হয়ে পড়ছি বাজির শব্দে...তবু আরো লুকোতে লুকোতে ঘুমিয়ে পড়ছে মন্ডপ..তুবড়ির জ্বলে যাওয়া খোল আমাদের সমস্ত দৃশ্যসুখের শান্তি নিয়ে উল্টে পড়ে আছে ঘাসে..রকেটের প্যাঁকাঠি উড়ে যেতে পারেনি যতদূর তার থেকে হয়ত বা সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে আমার মা বসন্তকুমারী কলেজ থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাস ধরবে বলে..আর আমার বাবা হয়ত কাছেই‚কল্যানিতে ফুটবলের খেপ খেলতে এসেছে....কিন্তু যেহেতু ফ্ল্যাশব্যাক সাদা কালোয় হয় আর অনন্ত তাই আমরা আড়াই চালে ঘোড়ার মত ফিরে যাবো জ্যাকেটের ভেতর সেই গল্পটায় যেটা চলছিল আসলে...
সেই শহরে আমরা‚মানে‚আমি জেঠু দিদি জেঠিমা জেঠুর বন্ধু তার স্ত্রী আর মেয়ে বেরিয়ে পড়েছি ঠাকুর দেখবো বলে...অজগরের মত লম্বা লাইনের দাঁড়িয়ে পড়েছি দমদম পার্কে...অজগরটা খুব আস্তে আস্তে এগোয়‚তার পেটের ভেতর আমরা ঘেমে উঠি আমাদেরই তৈরি এয়ারকন্ডিশনের সামনে....এরপর কাঁচ ভাঙে কারন জীবন ফেড আউটের সুযোগ দেয় না কাজেই.....আমি বয়ামের ভেতর থেকে দেখি সকাল হয়ে গেছে-আর জয় গোঁসাই বলেছেন-সকাল হলেই যত সমস্যা....তাই আমরা সকালের বিউটি নিয়ে না কপচে দেখবো মা কোথায়?..? মা উঠে পড়েছে...আমি শুনতে পাচ্ছি মা নজরুন গীতি গাইছে গুনগুন করে....বয়ামটা এখন মৃত মানুষের মত ঠান্ডা...আমি প্রায় চেঁচিয়ে মা'কে বলতে যাবো মাআআ চাদরটা দাও..ঠিক তখনই আমারই বিছানা থেকে একটা আমার মত ছেলে আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়, উঠে এলো‚ঠিক যে চাদরটা চাইতাম সেটা সরিয়েই...আমি প্রথমেই ঘাবড়ে যাই না কারন পাশাপাশি আর বড় বেশি কাছাকাছি থাকতে থাকতে আমরা এতটাই একে অপরের মত হয়ে পড়েছি যে নিজের মত মনে হয় অনেককেই....ফলত আমার এই কনফিউসনের সু্যোগ নিয়ে ছেলেটা আমার ব্রাশটা তুলে মাজতে শুরু করেছে। বয়ামের একধার থেকে আর একধারে ছুটে বেড়ানো ছাড়া আর কিই বা করতে পারি আমি?