Sunday 23 April 2017

রেমন্ড জে সেগার তাঁর “প্ল্যাঙ্ক,ফিজিসিস্ট”1 প্রবন্ধ শুরু করছেন এমনভাবে যা পড়ে মনে হয় হয়ত আকস্মিকভাবেই প্ল্যাঙ্ক একজন পদার্থবিদ হয়ে গেলেন,যিনি আদৌ কোনোদিন ভাবেননি বিজ্ঞানের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব চমকে দেবেন।“দ্য সেকেন্ড ক্রিয়েশনঃমেকার্স অফ দ্য রিভলুশন ইন টুয়েন্টিন্থ সেঞ্চুরি ফিজিক্স”2 গ্রন্থে প্ল্যাঙ্ককে কনসারভেটিভ বৈজ্ঞানিক বলা হচ্ছে,এর সঙ্গত কারনও আছে।যারা জে এল হিলরনের “ডিলেমাস অফ অ্যান আপরাইট ম্যান” পড়েছেন তারা হয়ত রোববার দুপুরে তর্ক জুড়তেই পারেন প্ল্যাঙ্ক কতটা ঝুঁকেছিলেন ধর্মের দিকে। যেখানে গুগল সার্চ করলে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ককে দশটার মধ্যে অন্তত তিনটে ওয়েবসাইট থাকবে যেখানে আদ্যপান্ত ধর্মীয় মানুষ হিসেবে দেখানো হবে সেখানে আদৌ কতখানি তর্কের জায়গা আছে তা নিয়ে সংশয় থাকতেই পারে,কিন্তু তবু কেন তর্ক করবো যে ওই যুগে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়েও প্ল্যাঙ্ক একজন স্বতন্ত্র মানুষ ছিলেন তার একটা কারন বলি। সেগারের প্রবন্ধে এক জায়গায় প্ল্যাঙ্কের সাথে চার্চের বিরোধের একটা তথ্য দেওয়া আছে,যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় প্ল্যাঙ্ক ধর্মে বিশ্বাসী হলেও তাকে একদমই অন্ধভক্তিতে পরিণত করতে চাইতেন না। এ কেমন কথা হল?এই ব্যাপারটা কেমন তা একটু পরিষ্কার করি।দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী “বইয়ের দেশ” এ একবার এক সাক্ষাৎকারে3 সুমন সেনগুপ্তকে বলেছিলেনঃ “তুমি মার্ক্সের মধ্যে তত নাস্তিকতা পাবে না,যতটা তুমি সংস্কৃতে পাবে।এসব জানা দরকার।সেসব জেনে আস্তিক হও। বন্ধুবর শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়-আস্তিক কাকে বলে? কাকে বলে নাস্তিক?-এ নিয়ে চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছেন......আমি তো ঈশ্বর মানি।কিন্তু আমি এসবও জানি।ফলে আজ যদি একজন নিরীশ্বরবাদী কেউ আমার সামনে আসেন,আমার তাঁকে দেখে ভয় করে না......বরং আমি তাকে ওয়েলকাম করি।তার কারণ,আমি তাঁদের দিকের যুক্তিটাও জানি।” আমার মতে এ ধারণা বোধহয় ক্ষতিকারক নয়,তর্ক থাকতেই পারে বা তর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক,কিন্তু সেই যুগে প্ল্যাঙ্কের কয়েকটি কাজ এবং বক্তব্য আমাকে ভাবতে বাধ্য করায় যে উনি অন্ধভক্ত ছিলেন না,এবং শুধুমাত্র হাইলাইট করা বক্তব্যগুলোয় আমি মানুষটিকে বিচার করতে রাজি নই।মনে রাখা প্রয়োজন প্ল্যাঙ্ক এবং বর্ন-হেবার সাইকেলের আবিষ্কারক ফ্রিৎজ হেবার ১৯২০ র অক্টোবরে “ইমার্জেন্সি অর্গানাইজেশন অফ জার্মান সায়েন্স” প্রতিষ্ঠা করছেন,যা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে লিপ্ত হয়, ঠিক এই সময় ওয়েস্ট জার্মানিতে নার্নস্ট আর রুবেন যারা জেমস চ্যাডুইকের শিক্ষক ছিলেন,রুহ্‌বেন ডিটেনশন ক্যাম্পে ছাত্রদের ল্যাব তৈরির জন্য লড়ছেন যুদ্ধপরবর্তী সময়ে।4মজার ব্যাপার এই মানুষটাই নাকি ১৯২০ থেকে আমৃত্যু এক চার্চের ওয়ার্ডেন ছিলেন।

কোয়ান্টাম স্টোরিঃ ১৮৯০ এর শেষদিক থেকে মোটামুটি ছ’বছর ম্যাক্স গবেষণা করেছেন আলো বিকিরণের ওপর।তাদের গতিপ্রকৃতির ওপর।১৮৯৪ এর পর তার আগ্রহের তালিকায় প্রবেশ করছে “ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশন”, তার দুবছর পর ১৮৯৬ এর ৭ই জানুয়ারি পঁয়েকার একজনের ভাঙা হাতের এক্সরে ফোটোগ্রাফ পান ডাক মারফত,ছবিগুলো পাঠিয়েছেন উইলহেম কনরাড রন্টজেন,যিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন এক্সরে।সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ,জে জে থমসন নামক একজন ইংরেজ বিজ্ঞানী সম্ভবত ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে ঠিক এই সময় আবিষ্কার করেছেন এক নতুন জিনিস, “ইলেক্ট্রন”।১৯০০ সালের ১৪ই ডিসেম্বর জন্ম নিচ্ছে “চাইল্ড অফ দ্য সেঞ্চুরি”- “কোয়ান্টাম”। কেমন ছিল আবিষ্কারের দীর্ঘ পথ? ১৯১৮ সালে স্টকহোমে নোবেল পুরষ্কার নিতে উঠে ম্যাক্স বলছেনঃ “Looking back over past twenty years to the time when the  idea of the physical quantum of  action and the measurement of it, first emerged into definite shape from a mass of experimental facts, and looking back beyond that over the long and labyrinthine path of which finally led to the discovery.”কোয়ান্টাম থিওরি পদার্থবিদদের এতটাই নাড়া দিয়েছিল যেন প্ল্যাঙ্ক এপিমেথিউসের মত কোনো এক প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছিলেন,খুলে দিয়েছিলেন এক নতুন পথের দিশা।কিন্তু মজার ব্যাপার প্ল্যাঙ্ক নিজের থিওরি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না,ভাবনা চিন্তার পর তিনি আরো অপছন্দ করতে শুরু করলেন এই নতুন আবিষ্কারকে। কোয়ান্টাইজড শক্তির কথা তার একটু খটকা লাগছিল,কারন তিনি কিছুতেই নিজেকে প্রমান করতে পারছিলেন না। প্ল্যাঙ্কের মৃত্যুর পর তাঁর ছাত্র জেমস ফ্রাঙ্ক বলেছেন তিনি ক্রমাগত বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রমান করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন,এমনকি একসময় তিনি কোয়ান্টাম থিওরিকে পাশে সরিয়ে রাখার চেষ্টাও করেন,কিন্তু অবশেষে তিনি স্বীকার করেন এবং প্রমান করেন কোয়ান্টাইজড শক্তির তত্ব। কিন্তু এই তত্ব যে ছড়িয়ে পড়বে বিভিন্ন শাখায় তা নিজেও মেনে নেন। কিভাবে ছড়িয়েছিল তা?আইনস্টাইন যখন ফোটন কণার ব্যাখ্যা দিলেন তখন কোয়ান্টাম থিওরি তাকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করল। চার্লস ম্যান এবং রবার্ট ক্রিজ মজা করে বলেছেন হয়ত কোয়ান্টামের আবিষ্কারকের থেকেও বেশি জরুরীভাবে এই থিওরিকে গ্রহণ করেছিলেন আইনস্টাইন। তাই জেমস মার্ফি প্ল্যাঙ্কের “হোয়্যার ইস সায়েন্স গোইং”5 অনুবাদ করার পর যখন ১৯৩২ নাগাদ এক সাক্ষাতে আইনস্টাইনকে অনুরোধ করেন তার বইয়ের ভূমিকা লিখে দিতে তখন বিনয়ী অ্যালবার্ট বলেন যে কোয়ান্টাম থিওরির আবিষ্কারকের মনে হয়না তাঁর মত “লেসার লুমিনারি অব্জেক্ট” দ্বারা আলোকিত হওয়ার দরকার আছে। আবার আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি যখন বেরচ্ছে তখন সমগ্র বিশ্বে যে গুটিকয় মানুষ তার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। অবশ্য এই আন্তরিকতার কারন যে শুধুমাত্র পারস্পরিক পিঠ চাপড়া চাপড়ি নয় তা বলাই বাহুল্য।
শেষ করব এক বাঙালির কথা দিয়ে। ১৯২৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বোস যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের অধ্যাপক তখন ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের সাহায্য ছাড়া প্ল্যাঙ্কের রেডিয়েশন ল এর ওপর একটা পেপার লেখেন।উনি যে পথে এই কাজ করলেন তাকে আমরা এখন কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিকস নামে চিনি!

টীকাঃ
1.http://www.asa3.org/ASA/PSCF/1985/JASA12-85Seeger2.html
2.The second creation: Makers of the revolution of Twentieth century Physics by Robert P. Crease and Charles C. Mann
3.জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৪ সংখ্যা।অরিন্দম চক্রবর্তী সাক্ষাৎকার
4.Brighter Than A Thousand Sun  by Robert Jungk
 5.Where the science is going by Max Planck
Translated by James Murphy

শুভ জন্মদিন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক!

No comments:

Post a Comment