Friday 20 January 2017

এপিক-চার-১
রজার এবার্ট মজা করে বলেছেন কুরোসাওয়ার “সেভেন সামুরাই” পরের অন্তত পঞ্চাশ বছরের জন্য অ্যাকশন হিরোদের কাজ জুগিয়েছে।একথার সরাসরি বিরোধিতায় যাবোনা,এবং তা মোটেই ধৃষ্টতাজনিত কারনে নয়।১৯৫৬ সালে তৈরি “সেভেন সামুরাই(শিচিনিন নো সামুরাই)” আমাকে,আজ এই যুগেও রোমাঞ্চিত করে লিবারাল আঙ্গিকের জন্য,লার্জার দ্যান লাইফ একটা চরিত্র ‘কিকুচিও’(তোশিরো মিফুনে)র জন্য আর গল্প বলার সাবলীলতার অদ্ভুত নিজস্ব স্টাইলে।আধভাঙা সিঁড়ির মত আমরা আগুনের সামনে থমকাবো এই সন্ধ্যেয়।অনেকে ‘ইকিরু’র কথা বলেন,আমি সত্যি কথা বলতে তা দেখিনি। তবে হ্যাঁ আমিও স্বীকার করি ‘রশোমন’ কুরোসাওয়ার উৎকৃষ্ট কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা।‘সেভেন সামুরাই’ আমাদের ষোড়শ শতকের জাপানী সামুরাই সংস্কৃতি,গ্রাম্য অ্যাম্বিয়েন্স,আর “ভয়” এই কয়েকটা জিনিস ডিফাইন করে। এখানে “ভয়” শব্দটা হিচককীয় অর্থে অবশ্যই ব্যবহৃত নয়,বরং অন দ্য কনট্রারি,একেবারের কুরোসাওয়াইয়ান “ভয়”,যার মধ্যে পরস্পরবিরোধী সত্বার হোমিসাইড পুরে দেওয়া থাকে।একদল লুটপাটকারীর ভয়ে প্রায় ন্যুব্জপ্রায় এক গ্রাম নিজেদের রক্ষার্থে ছয়জন সামুরাই ভাড়া করে,এর মধ্যে কিছুটা স্বেচ্ছায় যোগ দেয় কিকুচিও।এখানে কিকুচিওর অ্যাপিয়ারেন্স লক্ষ্যনীয়। সবার থেকে বড় একটা তলোয়ার কোমরে নিয়ে বা কখনও তলোয়ারটাকে কাঁধে নিয়ে(রাইফেল ভঙ্গিতে) দাঁড়ানোর যে ভঙ্গিমা তা হাস্যকৌতুকের,কিন্তু এই কিকুচিওর চরিত্রটিই ডিরেক্টরসাহেব সম্ভবত হ্যামার করার জন্যই তৈরি করেছিলেন।কিকুচিও পূর্বে একজন কৃষক ছিলেন,পরে সামুরাই হন।কিন্তু কৃষক প্রজাতির একটা সম্পূর্ণ বিপরীত দিক উনি উন্মোচন করেন গল্পের অর্ধভাগের আগেই,যা অন্তত এই ফিল্মটির পরিপ্রেক্ষিতে ওই স্থানে শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয় চমকপ্রদও। কুরোসাওয়া এক ঝটকায় শ্রেণীচেতনাকে জাগিয়ে তুলছেন এবং চোখে আঙুল দিয়ে বলছেন না গরীব মাত্রেই মহান এমন হয় না,তারাও মানুষ। প্রায় ঘাড় ধরে চরিত্রগুলোকে বাস্তবের মাটিতে টেনে আনা হচ্ছে।‘একজন লেখকের গল্প যখন বাস্তবতার সাথে আমাদের ঘুলিয়ে দেয় তাকে মহান বলে আখ্যা দেওয়া যায়’-কেউ একজন বলেছিলেন,আমি বলি সবসময় যে গল্পকে বাস্তব হতে এমন কোনো রুলবুক অবশ্যই নেই,বরং ফ্যান্টাসির জাল বিস্তার করতেই পারে।কিন্তু বাস্তবতার সাথে ডিল করে বানানো এই ফিল্ম কোনো অংশে ভাওতাব্জি মনে হয় না।একদম ক্যাটাগরাইজেশনের ভিত্তিতে এটি কতটা যুদ্ধের সিনেমা আর কতটা সোস্যাল রেসপন্সিবিলিটির তা বোঝা যায় না।  
ওপেনিং সিন 



রিকিচি
এপিক কি ক্যানোর কোনো স্পেসিফিক উত্তর হয় না।এই ছবিটি যখন শুরু হচ্ছে আমরা দেখতে পাই কিছু লোক ঘোড়ায় চড়ে আসছে বা যাচ্ছে নির্দিষ্ট এক স্থানের দিকে।কিছুক্ষণ পর তারা একটা পাহাড়ের ওপর থেকে একটা গ্রামের দিকে তাকায়,এবং খুবই বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সর্দার গোছের একজন বলেন যে এবার নয়,আগে বার্লিগুলো পেকে উঠুক তারপর আমরা আসবো। এই কথোপকথন গ্রামের একজন শুনে ফ্যালেন এবং তা গ্রামে গিয়ে অবিলম্বে জানান।দুটো মজার ব্যাপারের কথা বলি। প্রথমত,সন্দীপনের গদ্যে যেমন স্থান ইটসেলফ একটা চরিত্ররূপে অবস্থান করে তেমন এখানে পাহাড়ি গ্রামটি নিজেও এক চরিত্র,যার নিস্তব্ধতা,বৃষ্টির দিনের প্যাচপ্যাচে সন্ধ্যে বা ফুল ফুটে থাকা লুকোনো বাগান সবই যেন একটা মনুষ্য চরিত্রের বিভিন্ন মুড বা বিভিন্ন অনুভূতি।দ্বিতীয়ত আব্বাস কিয়েরোস্তামি ক্লোজ আপ শটে ঠিক যে ‘সাইলেন্স’-টা ক্রিয়েট করেন কুরোসাওয়া সেই ক্লোজ আপে আগুন এঁকেছেন। গ্রামের মানুষ ডাকাতের খবর পেয়ে এক জায়গায় জড়ো হন সমাধানের জন্য। কেউ বলেন চলো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাই? ডাকাত চলে যাওয়ার পর ম্যাজিস্ট্রেট আসেন, তাও খুব কম সময়ই হয়ত তাকে পাওয়া যায়, “He’s useless” এই যুক্তিতে এই প্রস্তাব খারিজ হয়। এরপর এক মা উঠে দাঁড়ান এবং বলেন সমস্ত ফসল,বার্লি ওদের দিয়ে দি বরং এবং নিজের গলায় দড়ি দিই,তাহলেই ম্যাজিস্ট্রেট দৌড়ে চলে আসবেন,তার মুখে অসহায়তা। লক্ষ্যণীয় দুটি বাচ্চা তাদের মা কে ধরে রেখেছে।অর্থাৎ একথা আসলে সচেতন কোনো সত্বাই বলতে পারে না,সাময়িক বিস্ফোরনের ফলে উৎসারিত এই কথা বলার সময় বিবেক তাকে বাধা দিচ্ছে,বাচ্চাদুটির আটকে রাখা তারই পোর্ট্রায়াল। বলেছিলাম আধভাঙা সিঁড়ির মত আমরা থমকাবো মাঝে মাঝেই। এই বৈঠক কি আমাদের জিবি নয়? এই অসহায় গ্রাম্য মানুষ কি আমরা নই? আমরাই তো। আমাদের সমস্যা নিয়ে আমরা কাদের কাছে যাবো এর সমাধান সম্ভবত আমরা এখনও পাইনি,কেউ এখনও রিকিচির মত উঠে দাঁড়িয়ে বলছে না-“We’ll kill them all”। খুব খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় রিকিচির ঠোঁট কাঁপছে,রাগে। ক্যামেরার ওপাশে প্রতিভাত এই রাগ আমাদেরও নয় কি? এই ফেটে পড়া আমাদেরও নয় কি?এখানেও যেমন সবাই-“Crazy Talk” বলে দমিয়ে দিচ্ছেন এই বিদ্রোহকে তারাও তো এ যুগে আছেন।লেলিহান শিখাকে হাত ধরে নীচের দিকে নামিয়ে আনার সংস্কৃতি তো আমাদের সমাজেও বিরল নয়।  

কথোপকথন এবং শট বিশ্লেষন
ক্যামেরা একজন মুখের,যে কিছু কথা বলছে, তার ক্লোজ আপে শুরু হওয়ার পর,কথার মাঝখানেই ঘরের বিভিন্ন জিনিস দ্যাখা যায় স্ক্রিনে,তারপর ক্যামেরা স্থির হয় ওপর একজনের মুখে,যে কথোপকথনের শ্রোতা।এই ইমপ্লিমেন্টেশনটা আমার বিশেষ পছন্দের।যা কুরোসাওয়ার “রশোমন”,”সেভেন সামুরাই” দুটো ছবিতেই প্রতিভাত হয়েছে।
(ক্রমশ)

No comments:

Post a Comment