এই লেখাটির নাম ‘ঝরা পাতা’ দিলে বেটার হত
আমি তো দু’জন ক্যান্সার পেশেন্টের কথাই বলতে
চেয়েছিলাম,ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালের এক কোনে দু’টো বেডে শুয়ে থাকে যারা
অন্ধ শ্রমিকের মত।
অনেক রক্ত পচাগলা দেহের ওপর সাদা চাদর পাতা দু’টো
বেড,বাস্তবিকই পরিচ্ছন্নতা দেখার মতন।
হ্যাঁ এখানেও একটা বেশ ফুরফুরে দুপুর নামে,নাইন্টিজে
বলিউডে যেরকম দুপুর দেখাতো সেরকম ব্যাস্ত নয়,তবে রোদ্দুরটা ওরকমই লাগে। হিসেবমত
জীবন তো একটা সিনেমাই। আবার সিনেমাও তো একটা জীবন। বাচ্চারা মুখে সবুজ রঙের মাস্ক
পরে বোবা এঞ্জেলের মত ছুটে ছুটে যাচ্ছে ফুলের কাছে,ফুল কিন্তু ডিস্ক্রিমিনেশন করছে
না,কারন ফুল ক্যান্সারের বুকের ওপর ফুটে ওঠার ধক রাখে।
“বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস”-তা ক্যান্সারও বন্দুকের
নলই,জীবনের দিকে তাক করা আছে,আদালতে দরজা খুলে গেলে ট্রিগার টিপে দেবে।
যখন আমার পিসতুতো ভাইকে দেখতে প্রথম গেছিলাম,তখন
বায়োলজিতে সদ্য বিনাইন আর ম্যালিগন্যান্ট এর মত টার্ম পড়েছি।রীতিমত রক্তগরম,যাওয়ার
পথে আমি তা জাহিরও করেছিলাম যদ্দুর মনে পড়ে।
সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো জানলাগুলো,ওরা নিজের মত,ওরা যেন
জানে না এ ঘরে জ্যোৎস্না নয়,প্রতিরাত্রে মৃত্যু ঢুকে পড়ে।টলমলে শরীর থেকে খুবলে
খুবলে তুলে নেয় চোখ,নাক,গলার অ্যাডামস অ্যাপ্ল...। আর তারপর থেকে যায় ওই সাদা
চাদর,যা প্রতিটা মৃত্যুর পর চাদর সেজে এসে শুয়ে পড়ে।এরকমই কোনো এক বিছানায়
কবি সুকান্ত হয়তবা প্রতিদিন লন্ড্রি থেকে
ফিরে আসছে যক্ষার রক্ত ধুয়ে ফেলে।
এ গল্পে কেউই সুকান্ত হয়ে ওঠেনি,এরা নিতান্তই “আট
নম্বর কাল মারা গ্যাছে”-র বাক্যেই সীমাবদ্ধ।তবু এদেরও একটা পরিচয় গড়ে ওঠে,অচেনা
কোনো সুন্দরী বাস থেকে নেমে যাওয়ার আগে একবার ফিরে তাকালে যেমন হয়,তেমনটা।ভাইকে
দেখতে গিয়ে আলাপও হয়েছিলো,এখন মনে পড়ে না।সাড়ে চারটের দুপুরে বাচ্চাগুলো সবুজ
বাগানে আস্তে আস্তে হাঁপিয়ে উঠছিলো।
শিশিরের সাথে পিয়ালীর দ্যাখা যেদিন হয়েছিলো সেদিন
শিশির পিয়ালীর অ্যাপিয়ারেন্সে সবার আগে যেটা লক্ষ করেছিলো তা হল গ্রীবা,দীর্ঘ
গ্রীবা।চোয়ালের নীচ থেকে যেন একটা গোপন ঝরনা নেমে এসেছে।অথচ মজার ব্যাপার মাত্র
দু’দিনের মধ্যেই জানতে পারল যে পিয়ালীর গলাতেই থাবা বসিয়েছে কর্কট।এবং ট্রান্সফার
হতে হয় অন্য ডিপার্টমেন্টে। শিশির তারপর থেকে প্রতিদিন বিকেলের ওষুধের টাইমের আগে
বাগানে আতিপাতি খুঁজেছে পিয়ালীকে,শেষমশ দেখতে পেলো ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার
হাসপাতালের মেইন বিল্ডিংটার ঠিক সামনে একটা যত্নের আতিশয্যে কিছুটা হেজে ওঠা পুলের
সামনে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো জলের দিকে। ঠিক এরপরই শিশির এগিয়ে যেতে গিয়ে আস্তে
আস্তে প্রায় মিলিয়ে গেছিলো পেভমেন্টে। আর জেগে উঠেছিলো পিয়ালীর থেকে মাত্র তিনহাত
দূরে,এইবুঝি তার দ্বিতীয়বার জেগে ওঠা।এবার আফসোস হল এই যে তার ঠোঁটে ক্যান্সার হলে
সে বুঝি বেঁচে যেত। গল্পে সমতা বজায় থাকত।কিন্তু আমি একটা চালাকি করেছি যাতে এটা
গল্প না হয়ে ওঠে ক্যাটাগরিক্যালি তা আটকানোর জন্য, কলমটাকে দু’আঙুলের মাঝে ঢুকিয়ে
বলেছি-যাও তো একটু ঘুরে এসো,সে নিজের মত ঘুরতে গ্যাছে,নিজের মত ঘুরছে,থুড়ি,লিখছে।
নাহলে আমিও তো একটা টিটোয়েন্টি মহাকাব্য লিখতে চাই।
সেদিন বেডে ফিরে শিশির মনে মনে ভেবেছিলো-ধুর
শালা,ক্যান্সার দিলি তো দিলি রক্তে দিলি না,মধ্যবিত্তর মহাব্বতে হলের ভিতরেই
শুরু,হলের ভিতরেই শেষ।পরেরদিন নার্স এসে বলে যে এবারের মত তার ট্রিটমেন্ট শেষ,আজ
তার ছুটি হবে।
সিনেমা হলে ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা রক মিউজিক দেওয়া
যেত,কিন্তু জীবন আক্ষরিকই কম্পোজিশনের সময় দেয় না।বিল্ডিং থেকে বেরোবার সময় সেই
পুকুরটার সামনে দাঁড়িয়ে পিয়ালী একটা অবান্তর কথা বলেছিল। বলেছিলো
-‘আমার নাম পিয়ালী,আপনার
নামটা জানতে চাই না, কিন্তু আপনার সাথে আর যেন দ্যাখা না হয়’।
No comments:
Post a Comment