Monday 1 June 2020

সবুজ বোতাম


                  


                     সবুজ বোতাম 

হাই পাঠাবো? এই প্রশ্নটা গত দু’দিন ধরে মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কি ভাব্বে? যাই ভাবুক,পাঠিয়ে দেখি? আমরা যারা হঠাৎ একা, যারা হঠাৎ এলোমেলো তাদের ভাবনা গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়ে। শেষমেশ একটা হাই পাঠালাম। উত্তর নেই। নিউ মার্কেট থেকে অল্প কিছু কেনাকাটা করে বাসে উঠলাম। আকাশে মেঘ, মেসেঞ্জারেও। নেটটা অফ করে রেখেছি। মেসেজ এলে? আসুক। কখন হাই পাঠিয়েছি, এত দেরি হয়? আমিও দেরি করে রিপ্লাই দেবো। বাসের জানলা দিয়ে হাওয়া আসছে, শহীদ মিনারের দিকে তাকালাম,কি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা আমরা কেন গাছের মত শান্ত হতে পারি না?বাসের জানলা থেকে আমি দেখেছি কলকাতায় সন্ধ্যে নামে, যেভাবে প্রেমিকার ঝুপ করে অভিমান হয়,তেমন। নাহ্‌,নেটটা একবার অন করি। অন করতেই টুং করে একটা মেসেজ। বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। প্রিয় পদটাকে যেমন আমরা খাওয়ার সময় বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে খাই, তেমন আমিও ফোনে অকারণ কয়েকটা কাজ করে মেসেজটা দেখলাম। “হাই”। মুশকিল হল এরপর কি বলবো? লিখলাম-কি করেন? এবার রিপ্লাই কিছুটা জলদি-এমএসসি কমপ্লিট। 
পিএইচডি করবেন? 
নাহ্‌।জব।
আচ্ছা। 
আবার কথা শেষ। ধুর এভাবে হয় নাকি? আমিই প্রশ্ন করে যাবো? লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম
বই পড়েন?
হ্যাঁ,খুবই।
সবরকম?
হ্যাঁ আমি সর্বভুকই! 
মনে মনে ভাবলাম যাক টপিক পাওয়া গ্যালো। টুং করে আবার একটা মেসেজ।
আপনার ভালো লাগে বই পড়তে?
এই প্রশ্নটা আমার জন্য লুজ বল,ছয় না মারলেই নয়।
বললাম- হুম,আমি পেটুক রিডার। 
আমার বাস ততক্ষণে হাওড়া ব্রিজে উঠে পড়েছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে শহরটাকে আরো একবার দেখলাম, এখন আর অভিমান নেই, হলুদ বাতিগুলো গয়নার মত লাগছে। 


ডিনার করে এসে একটা বই নিলাম পড়বো। হাইজেনবার্গ লোকটা বেশ ঝরঝরে লেখেন। বহুদিন পর কিছু লিখতে ইচ্ছে হল। কিন্তু সাবলীল লেখা এলো না। বইটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। ফোনটা চার্জ থেকে খুলে মেসেজ করলাম-
হাইজেনবার্গের এই বইটা পড়েছেন?
তার নামের নীচে তখন টেন মিনিটস অ্যাগো দেখাচ্ছে। ফোনটা রেখে দিয়ে আবার বইটা পড়ার চেষ্টা করলাম। বুঝলাম মনও ইলেক্ট্রনের মত ডুয়াল নেচারের জিনিস। এবং অনিশ্চয়তা নীতি মেনে তার অবস্থান আর ভরবেগ একইসঙ্গে নির্ণয় করা সম্ভব না। আমি ল্যাদ খেয়ে বসে রইলাম আবার। ঠিক যেই হাল্কা ঝিম ভাব এসেছে তখনই মেসেজটা এলো-
না তো। কি নিয়ে?
এটা ফিজিক্স এবং ফিলোসফি নিয়ে। খুব ভালো লেখা। পড়ে দেখবেন। 
আচ্ছা।তো আপনি কি স্টুডেন্ট? 
হুম।হয়ত সমবয়সীই হবো। 
(হঠাৎ খেয়াল হল আমার কিছু বন্ধু ওনার কমন ফ্রেন্ড। এই পরিচিতি গুলো জীবনে দৈব আশীর্বাদের মত নামে। আসলে আমি এন্ট্রপি প্রিয় মানুষ, ছড়িয়ে মাঠ ময়দান আমার অন্যতম প্রতিভা, কিন্তু হঠাৎ খুব গোছনো হলাম। ধীরে এগোতে হবে।)
আমায় আপনির থেকে তুই বললেই খুশি হই তাহলে।
শেষের কবিতায় অমিত লাবণ্যকে বলেছিল বেগ দ্রুত করতে হলে বস্তু কমাতে হয়, তাই অমিতবাবু নয়, শুধু অমিত। 
আমি অমিত নই, কিন্তু অপরজনকে লাবণ্য ভাবতে দোষ কোথায়? গল্পের গরু গাছে ওঠে আমি বুর্জ খলিফায় তুলে দিয়েছি। 
বললাম-বেশ। তুইই বলবো। 
ব্যাপার হল আপনির মধ্যে যে দূরত্বটা আছে ‘তুই’ তে সেটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। কেন? এটা অনেকটা অন্য ডিপার্টমেন্টের মেয়ের প্রেমের পড়ার মতন। তবে আসল কথা হল ‘তুই’ থেকে ফ্রেন্ডজোনের দূরত্ব খুব কম।   

আমি জিজ্ঞেস করলাম- পিএচডি করবি না কেন?
নাহ্‌,ইচ্ছে নেই। তাও একবার নেটটা দেবো। 
আচ্ছা, দেখ ট্রাই কর। 
কথায় কথায় আমি যে একটু আধটু লিখি তা বলা হল। তারপর হঠাতই দেখি আর কোনো রিপ্লাই নেই! আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম রাত দেড়টা। ঘুমিয়ে পড়ল? এমন আচমকা? আমি নিজেকে রেক্টিফাই করে নিচ্ছি শুধু মন নয়, মেয়েরাও হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি মেনে চলে। আচ্ছা প্রকৃতি কি মেয়ে? এরকম মাঝরাস্তায় ঘেঁটে দেয় কেন? কোয়ান্টামটা জানতে দিল, অথচ বুঝিয়ে দিল যত জানবো তত ঘেঁটে যাবো। আড়ালে বসে এই মুচকি মুচকি হাসিটা প্রকৃতির ধর্ম,মেয়েদেরও। 

আমি ফোনটা রেখে বসলাম লিখতে। একটা সামান্য চিঠি। সময়ের সাথে সাথে কথায় কথা বাড়তে বাড়তে যখন আমার সব দোষ ত্রুটি ধরা পড়ে যাবে, যখন আমি আড়াল পাবো না, তখন এই চিঠিটাকে ঢাল করবো এমনটাই উদ্দেশ্য। 

ধরো তোমার নাম ‘কিচ্ছু না’, অথচ সবকিছু! 
এ চিঠির প্রথমেই যে দ্বিধা এসে পড়ল তা হল সম্বোধন কি বলে করা উচিত,অন্তত চিঠির মধ্যে-‘তুই’ না ‘তুমি’? মুশকিল হল আমার কাব্যঢং,আমার স্বাভাবিক নাটুকেপনা আমাকে ‘তুমি’ বলতে জোর করে,আমার বাস্তবতা আমাকে ‘তুই’ বলতে বাধ্য করায়।ঠিক যেমন মেয়েদের সাজ,প্রয়োজনকে তুচ্ছ করে যেখানে ইচ্ছা বড় হয়ে উঠেছে,তাতে যেমন জাহির করার দোষ আছে তেমনই দর্শকের চোখ জুড়িয়ে দেওয়ার তৃপ্তি।না সাজলেও তাদের চলে যেত,কিন্তু আমাদের চলত না।এ তাদের স্নেহ,আমাদের দৃষ্টির অক্ষমতা।তাই মানুষটি না চাইলেও তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে বিরম্বনায় ফেলা এক স্বভাব,এখানে তার চেয়ে নিজের স্বার্থ বেশি। আমি এই দুইকেই অস্বীকার করতে পারি না। কারন যে ভাষায় কাছের মানুষ ধরা দেয় সে ভাষা ভালো ভাষা, শ্রেষ্ঠ ভাষা নয়,বরং যে ভাষায় আমি আড়াল পাই,যে ভাষা আমাকে সময়মত লুকিয়ে পড়ার অবকাশ দেয় তাই শ্রেষ্ঠ ভাষা। কাছের মানুষের কষ্ট কখনও কখনও নিজের থেকেও বেশি বুকে বাজে,আর ঠিক সেই কারনেই যা কিছু সত্যি তাই সবসময় সঠিক নয় সম্পর্কে, মিথ্যেও সঠিক হয়ে ওঠে।বিজ্ঞানীদের কাছে খাটি সোনা এক জিনিস,আর স্যাকরার কাছে আরেক। বিজ্ঞানী শুদ্ধতাকে তুলে ধরতে চায়, আর স্যাকরা মজবুতি। তাই স্যাকরা খাদ মেশায়। আমি বলি সম্পর্ক স্যাকরার কৌশলেই চলা ভালো,কেননা সে মজবুতির খাতিরে খাদ মেশায়, শুধুমাত্র শুদ্ধতার খাতিরে তাকে বিরক্ত করে তোলে না। 

 “ঘরে বাইরে” উপন্যাসে নিখিলেশ এক জায়গায় বলেছেন-‘আমার মনের বোধশক্তি হঠাৎ এমন ভয়ানক বেড়ে উঠেছে যে,যে দুঃখ আমার অতীতের বুকের ভেতর সুখের ছদ্মবেশ পরে লুকিয়ে বসেছিল তার সমস্ত মিথ্যা আজ আমার নাড়ি টেনে টেনে ছিঁড়ছে;আর যে লজ্জা যে দুঃখ ঘিনিয়ে এলো বলে,সে যতই প্রাণপণে আমার হৃদয়ের সামনে ততই তার আবরু ঘুচে গেল। আমার সমস্ত হৃদয় দৃষ্টিতে ভরে গিয়েছে-যা দেখবার নয়,যা দেখতে চাই নে,তাও বসে বসে দেখচি’। এর মধ্যে একটা গভীর অসহায়তা প্রকাশ পেয়েছে,তা শুধু নিখিলেশের নয় তা সারা বিশ্বের সমস্ত প্রেমিকের অসহায়তা।এখানেই রবি ঠাকুরের সার্থকতা। নোলানের “ব্যাটম্যানঃদ্য ডার্ক নাইট” সিনেমায় জোকার বলেছিল যে সমাজের ভালো মানুষগুলোকে যে মুহুর্তে তাদের ভালো পরিবেশের বাইরে নিয়ে যাবে,সেই মুহুর্তে সে তার ভালোমানুষির মুখোশ খুলে বেরিয়ে আসবে। আর তাই আমি বলি ঝগড়া আমাদের বিচ্ছেদ নয়,বরং গভীর মিলনের ছল। ঝগড়া আমাদের ভেঙে ফ্যালে না, আমাদের আরো শুদ্ধতায় গড়ে তোলে। লেখকের ডাস্টবিনে যা কিছু বাতিল, তা কিন্তু আসলে পরিণত লেখাকেই আরো পরিণত করে। তাই শুদ্ধতার জন্য যাচাই  করে নেওয়া জরুরী। তবে কিনা প্রেম সবসময় শুদ্ধতার ভিখারি নয়,বরঞ্চ একটু অশুদ্ধতা,নষ্টামি এইসবও সে চায়। অর্থাৎ কিনা গুরুদেবের ভাষায় প্রেম শুধু অক্সিজেনে শ্বাস নেয় না, আগুনও জ্বালায়। টেরাকোটার মূর্তির গায়ে তার পোড়া দাগ তারই সৌন্দর্য্যের প্রতীক,তার লজ্জা নয়। প্রেমের চোখে কান্নাকাটির দাগ তেমনই এক সৌন্দর্য্যের প্রতীক,তা অস্বীকারের নয়। প্রেম জবা নয়,গোলাপ ফুল চায়। ভক্তি নয়, ভালোবাসা চায়। এই ভালোবাসা আস্তে আস্তে আমাদের মনে জাঁকিয়ে বসে ওদিকের মানুষটাকে নিজের দিকে টেনে আনে।এবং সময়মত তার ওপর অধিকার ফলায়। এতে দোষ অধিকারীর,প্রেমের নয়। প্রেম কোভ্যালেন্ট আর আয়োনিক হতে পারে,নন-কোভ্যালেন্ট হতে পারে না। কোভ্যালেন্ট হল দুপক্ষের প্রেম, আয়োনিক হল দুটি বিপরীত ধর্মের প্রেম,তাদের যা কিছু অমিল তাই যেন তাদের শক্তি। কিন্তু নন-কোভ্যালেন্ট হল ভালোবাসা,প্রেম নয়। আমাদের হল আয়োনিক প্রেম। 
প্রথমেই বলি প্রেম খানিকটা যোজ্যতার মত,সে বাইরের কক্ষের জৌলুসেই আসক্ত হয়। তড়িৎযোজ্যতায় এক স্বাভাবিক প্রবণতা আছে ল্যাটিস শক্তি নির্গত করার। দৃঢ় কেলাস গঠন করে একসাথে থাকা,এবং যা কিছু বাধা সমস্ত জালক শক্তি রূপে বের করে দেওয়া। কিন্তু মৌল যেভাবে গঠিত হয়,সম্পর্ক সেভাবে গঠিত হয় না। কেননা তড়িৎযোজী বন্ধনে দুটি মৌলের মন নেই,প্রকৃতির যা নিয়ম তা তারা চ্যালেঞ্জ করতে পারে না, কিন্তু সম্পর্কের দুটি মানুষ তা পারে। এবং তা পারে বলেই সম্পর্কের নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। 

পুনশ্চঃ এই চিঠি আসলেই আমাকে ব্যাখ্যা করে।কিন্তু এই চিঠির অক্ষমতা যে এই চিঠি শুধুই আমার দৃষ্টিতে লেখা। আর ঠিক এই কারনেই আমি এর পালটা চিঠি দাবি করছি,অপর দিকের মানুষটার চোখে আমি কেমন তা বোঝার এবং জানার খাতিরে।   

পরেরদিন রাতের দিকে যখন আমার টাইমলাইন তোলপাড় শব্দের খেলায় একটা ছোট্ট মেসেজ এসেছিল-
একটু শান্ত হ! আমিও হই। 
আমি তো জানিই চিনচিনের একটাই ঠিকানা, মনকেমনের ভেক্টর নেই। শান্ত হবো? আমি তো নোবেল গ্যাস নই? আমি তো ডাবল বন্ডে পূর্ণ আনস্যাচুরেটেড মানুষ। আমি তো দুঃখকে শূন্য দিয়ে গুন করা মানুষ। আজ হঠাৎ এক দিয়ে গুন করে ফেললাম কেন?   

No comments:

Post a Comment